
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরি করে যাচ্ছে তবে রসায়নশাস্ত্র এবং জীববিদ্যাকে একত্রিত করে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে এক অভিনব পরিবর্তন এসেছে চিকিৎসাক্ষেত্রে। যার মধ্যে অন্যতম বড় আবিষ্কার হলো অ্যান্টিবায়োটিক। যা আমাদের দেহের বিভিন্ন রোগকে খুবই দ্রুত সারিয়ে ফেলতে সক্ষম ছিলো।
কিন্তু বিগত কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের শরীরের যেমন উপকারী তেমন অপকারীও। বর্তমানে ৮২ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক ঠিকমতো শরীরে কাজও করছে না। অ্যাান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে, যা চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ।
অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ এবং জটিল। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পথে অনেক বিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে। তবে, অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ছিলেন একজন স্কটিশ ব্যাকটেরোলজিস্ট। তিনি ১৯২৮ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। ফ্লেমিং তখন লন্ডনের সেন্ট মেরিস হাসপাতালে কাজ করছিলেন। একদিন তিনি তার পরীক্ষাগারে একটি ছত্রাক দেখতে পান। তিনি লক্ষ্য করেন যে, এই ছত্রাকটি তার পরীক্ষাগারে থাকা স্টেফিলোকক্কাস অরিয়াস ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলছে। ফ্লেমিং এই ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারেন এবং তিনি এই ছত্রাকের থেকে একটি অ্যাকটিভ উপাদান নিষ্কাশন করেন। তিনি এই উপাদানের নাম দেন পেনিসিলিন। ফ্লেমিং তার আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝতে পারেন এবং তিনি এটি প্রকাশ করেন।
nagad
১৯৩০-এর দশকে, হাওয়ার্ড ফ্লোরি এবং এরন হেয়ার গবেষণার মাধ্যমে পেনিসিলিনের চিকিৎসাগত গুরুত্ব প্রমাণ করেন। তারা পেনিসিলিনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ নিরাময় করতে সক্ষম হন। ১৯৪০-এর দশকে, পেনিসিলিন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়। এরপর থেকে পেনিসিলিন ব্যাপকভাবে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
কিছু উল্লেখযোগ্য অ্যান্টিবায়োটিকগুলো হলো স্ট্রেটোমাইসিন (১৯৪৩), ক্লোরামফেনিকল (১৯৪৭), টেট্রাসাইক্লিন (১৯৪৮), মাইক্রোব্যাকটিন (১৯৫২), ক্যানডিডাইসিন (১৯৫৫), জেনিসিন (১৯৫৯), সিফ্রান্টিন (১৯৬৭), সেফোটেতান (১৯৭১), সেফোক্সিম (১৯৭৮), যা উল্লেখযোগ্য সাড়া ফেলেছিলো সম্পূর্ণ পৃথিবীতে।
প্রয়োজন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এর ফলে সহজ সর্দি, কাশি, জ্বর, ঠান্ডা লাগা, চর্মরোগ ইত্যাদি রোগে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। এমনকি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর হতে পারে না। প্রয়োজন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে পেট খারাপ, ডায়রিয়া, বমি, মাথাব্যথা, ত্বকের সমস্যা ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে কিডনি, যকৃত, হৃৎপিণ্ডসহ অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক অন্যান্য ওষুধের সাথে প্রতিক্রিয়া করতে পারে। এর ফলে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে বা নতুন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আইইডিসিআরের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা. হাবিব জানিয়েছেন ‘বাংলাদেশে বহু মানুষ বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ফার্মেসিতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করে। তাদের মধ্যে ধারণাই নাই যে এর ফলে তার শরীর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পরবর্তীতে কোনো সংক্রমণ হলে সেটা আর কোনো ওষুধে হয়তো সারবে না।’
এছাড়া অধ্যাপক তাহমিনা বলছেন, আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে, মানুষের সঙ্গে-সঙ্গে প্রাণীর ওপরেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়, যা কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না, মাটিতে রয়ে যায়। এর ফলে আমরা যা খাই, সবজি, ফল বা মাছ মাংস এর মধ্যে থেকে যাওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট হয়ে থাকে। তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাচ্ছি তার অনেক থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যেমন : মুরগির মাংস, গরু বা খাসির মাংস, দুধ এবং দুগ্ধ জাতীয় খাবার, মাছেও হরমোন ব্যবহার করা হয়, সেখানেও অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় রোগ প্রতিরোধী করার জন্য। চিকিৎসক এবং গবেষকেরা বলছেন, এর ফলে শিশু এবং হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। সেজন্য সরকারকে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তারা।
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা এবং অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন করা। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণেরও ভূমিকা রয়েছে। এজন্য সবাইকে প্রয়োজন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি নিতে হবে। সরকার এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলকে এই ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে।