
একটি সভ্য দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, মূল্যবোধ আর উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় ঘুষ, দুর্নীতি। উন্নয়ন ও ঘুষ, দুর্নীতি পাশাপাশি চলতে পারে না। যে কোনো দেশের উন্নয়ন বলি, গণতন্ত্র বলি, সভ্যতা বলি, সংস্কৃতি বলি, ভাষা বলি, মূল্যবোধ বলি, নৈতিকতা বলি এসবের প্রধান শত্রু ঘুষ ও দুর্নীতি। ঘুষ, দুর্নীতি শ্রেণি বৈষম্য এবং আয় বৈষম্য তৈরি করে। দুর্নীতির প্রভাবে দেশের গতিশীল অর্থনীতিতে স্থবিরতা তৈরি হয় । ঘুষ দুর্নীতির মধ্য দিয়ে মানুষের নৈতিক বিপর্যয় ঘটে। মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব সংঘাত, খুন, ছিনতাই, মাদকাসক্ত ধর্ষণ, কিশোর গ্যাং, নির্যাতন, গুম প্রভৃতি অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

সংগৃহিত
তবে এ কথা ঠিক একটি দেশের সব মানুষ কিন্তু দুর্নীতি পরায়ণ বা দুর্নীতিবাজ নয়। দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা খুবই নগন্য। আমরা যখন নিজেদের অপরাধ লুকাতে অন্যের অপরাধকে বড় করে সামনে তুলে ধরি তখন দুর্নীতিবাজরা প্রশ্রয় পায়, ঘুষখোররা উৎসাহিত হয় এবং রাষ্ট্র শক্তির কাছে আশ্রয় খোঁজে। আমাদের উন্নয়নকে গতিশীল এবং ত্বরান্বিত করতে হলে, দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে ঘুষ ও দুর্নীতি রোধের কোন বিকল্প নেই। দুর্নীতি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগেই তা রোধ করতে হতে হবে। তা না হলে দেশের উন্নয়ন,অর্থনীতি, শিল্প, শিক্ষা, গবেষণা, স্বাস্থ্য মুখ থুবড়ে পড়বে।
স্বজনপ্রীতি, অবৈধ ক্ষমতার চর্চা এবং রাজনৈতিক দুর্বৃতায়ন দুর্নীতির প্রধান কারণ। অবৈধ উপার্জন বৈধ করার সুযোগ দেশের দুর্নীতিকে উৎসাহ জোগায়। ক্ষমতাসীন দলের লেবেল ব্যবহার করা এবং তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করা দুর্নীতি লুটপাটের আরো একটি বড় কারণ। কখনো বুঝে আবার কখনো না বুঝে আমরা দুর্নীতি লুটপাটের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করি। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার, ঋণখেলাপি একটি দেশের জন্য সবসময়ই অভিশাপ। সামাজিক অবকাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া এগুলো বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় প্রভাবমুক্ত না রাখতে পারলে দুর্নীতি ও লুটপাট রোধ করা সম্ভব হবে না। দুর্নীতি লুটপাট অনেকটাই মরণব্যাধি ক্যান্সারের মতো রূপ নিয়েছে আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থায়। ক্যান্সার রোধ করতে যেমন প্রথম ধাপেই চিকিৎসা করতে হয় তা না হলে তাকে যেমন ভালো করা যায় না ঠিক তেমনি লুটপাট দুর্নীতিকে প্রথমে রোধ করতে না পারলে দেশ ও জাতির জন্য তা মহাবিপদ সংকেত হয়ে পড়ে।
nagad
অর্থনৈতিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী দেশে থেকে প্রতিবছর বিদেশে পাচার হয় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সরকারের সাফল্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি আছে বলেই বিদেশে টাকা পাচার বৃদ্ধি, ঋণখেলাপির পরিমাণ বৃদ্ধি, চোরাচালান-চোরাকারবারি, মাদক কারবার, অপরাধ এবং অপরাধীরদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে হুহু করে। ঘুষ এবং দুর্নীতি আছে বলেই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দ্রবমূল্য বৃদ্ধি করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমরা বড় বড় চোর ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজদের সম্মান করছি, আদর্শ মনে করছি। নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে সর্বত্র। হারিয়ে ফেলছি লজ্জাবোধকে।
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির মধ্যে ভূমি অফিস, পাসপোর্ট অফিস, স্বাস্থ্য, ওয়াসা, খাদ্য, পুলিশ প্রসাশন, এলজিআরডি, এলজিইডি, বন্দর, রেল, বিমান, বিআরটিসি, বিআরটি এ প্রভৃতি সেবা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির শীর্ষে। এই দুর্নীতি কার স্বার্থে ? কতিপয় ব্যক্তি নাকি রাষ্ট্রের স্বার্থে ? একটা বিষয় আমাদের মাথায় রাখা দরকার অর্থাৎ যারা রাষ্ট্রের এই দুর্নীতি রোধ করবেন তাদের মনে রাখা দরকার ব্যক্তি কখনো রাষ্ট্রের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাবান হতে পারে না। রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাবান হয়। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার, ঋণখেলাপির কারণে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ভঙ্গ হলে সেই রাষ্ট্র বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারে না।
আমারা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, লাখো শহিদের রক্তের দামে কেনা বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তারা যেই সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখে নিজের জীবন দিয়েছেন। আমরা সেই সোনার বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। কিন্তু রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কেউ যদি দুর্নীতির কোন বিষয় বা চিত্র নিয়ে বলেন এগুলো ছিঁচকে কাজ তাহলে পক্ষান্তরে অপরাধীরা এবং দুর্নীতিবাজরা আরো বড় অপরাধ এবং দুর্নীতির জন্য সায় পেয়ে যাচ্ছেন। একজন সাধারণ মানুষ যা খুশি বলতে পারেন তবে সেটাও তার সীমার মধ্যে থাকা উচিৎ। কিন্তু রাষ্ট্রের কোন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোন কিছু সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে ভেবে চিন্তে করা উচিৎ বলে আমরা বিশ্বাস করি। কারণ আমরা তাদেরে কাছ থেকেই শিখি এবং শিখবো।
ব্যক্তি এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানেরর দুর্নীতির কারণে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ চলাকালীন সময়েই তা ভেঙে পড়ছে আমরা তা মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পারি। দুর্নীতিকে সহায়তা করে ঘুষ এবং পারসেন্টটেস নামের দোষবাচক বিশেষেণ। আর এর খেসারত দেয় রাষ্টের সাধারণ জনগণ এবং ভুর্তকি দেয় রাষ্ট্র।
আর্থসামাজিক উন্নয়নের জোয়ারে বেড়েছে দুর্নীতিও। দুর্নীতিবাজরা সবসময় ক্ষমতাশীন দলের ছত্রছায়ায় থাকছে। জানিনা আমার মতো আর ক’জন এমন আহত হন ঘুষখোর, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, মাদক ব্যবসায়ী এবং চোরাকারবারীদের নামের সাথে বিশিষ্ট সমাজসেবক, জনদরদি ইত্যাদি বিশেষণগুলো দেখে। দুর্নীতির কারণে এক শ্রেণির মানুষ রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হচ্ছে । রাষ্ট্র তাদের সম্পর্কে প্রায় নীরব। রাষ্ট্রের এই নীরবতা অন্যদেরকে ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার, ঋণখেলাপিকে উৎসাহিত করছে। দুর্নীতির কারণে সরকারের প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগলো নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে কাজ করছে না। বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা দুর্নীতির একটি বড় কারণ।
দুর্নীতিকে রোধ করতে একটি গণজাগরণের প্রয়োজন। একটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও সফলতা নির্ভর করে সেই রাষ্ট্র ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কতটা সোচ্চার, কতটা কঠোর এবং তা প্রতিরোধ করতে কতটুকু সামর্থ্য অর্জন করেছে তার ওপর। ঘুষখোর, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, মাদক ব্যবসায়ী এবং চোরাকারবারিরা দেশ সমাজ এবং একটি জাতির জন্য যেমন ভয়ংকর বিপজ্জনক ঠিক ততটাই ভয়ংকর বিপজ্জনক একটি রাজনৈতিক দলের জন্য, একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য। সমাজের পরতে পরতে দুর্নীতি বাসা বুনতে শুরু করেছে। এটা এক ধরনের সন্ত্রাস। দুর্নীতির লালন-পালনে সামাজিক সংকট তৈরি হয়। দুর্নীতির কারণে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্র ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই ফণা তোলার আগেই বিষ দাঁত ভেঙে দিতে হবে। দেশের প্রতি, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকলে, গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকলে, রাজনৈতিক অঙ্গীকার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকলে ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার, ঋণখেলাপি রোধ করা সম্ভব নয়। দুর্নীতির ফিরিস্তি বলে শেষ করা যাবে না।
আমরা সবাই কম বেশি দুর্নীতি সম্পর্কে, দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে জানি। ভয় এবং সামাজিক ঐক্য ও সামাজিক আন্দোলন না থাকার কারণে আমরা তা বলতে পারছি না। দুর্নীতিবাজরা সমাজ ও রাষ্ট্রকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারের দিকে। দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পরিণত হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার কখনো দুর্নীতির দায়কে এড়াতে পারে না। দেশ এবং দেশের জনগণের স্বার্থে যে কোন মূল্যে ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার, ঋণখেলাপি রোধ করতে হবে। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার, ঋণখেলাপি রোধ করতে হলে সরকারের সকল প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সচল রাখতে হবে। দুর্নীতিবাজদের কালো তালিকাভুক্ত করে জনসম্মুখে তা উন্মোচন করে দিতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট