Home » আগামীর বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জ

আগামীর বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জ

by নিউজ ডেস্ক
৫২ views

রেদোয়ান ইসলাম, রাবি:

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে প্রধানমন্ত্রীই নির্বাহী ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত, যার মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হয়। ফলে, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের প্রশ্ন এলে তা শুধু সাংবিধানিক নয়, বরং প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।

আমরা যদি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের বিষয়ে চিন্তা করি, তাহলে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে চলে আসে—
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কি নিশ্চিত থাকবে?
ক্ষমতার ভারসাম্য কি সত্যিই কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, নাকি নতুন সংকট তৈরি করবে?
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি আরও শক্তিশালী হবে, নাকি দুর্বল হবে?

banner

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা, প্রশাসনিক কাঠামো ও সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সংকট

একটি কার্যকর সরকার পরিচালনার জন্য স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি। যদি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো হয়, তাহলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ নীতি গ্রহণে জটিলতা দেখা দিতে পারে, বিশেষত যখন সংসদে কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়।

এক্ষেত্রে আশঙ্কার জায়গা হলো, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের নামে যদি রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়, তাহলে সরকার পরিচালনায় একধরনের নীতিগত অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে।

২. কার্যনির্বাহী শাখার দ্বৈততা ও সংঘাত

প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করলে সংঘাত তৈরি হতে পারে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি, ১৯৯১ সালের আগে রাষ্ট্রপতি শাসিত বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রায়শই রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছিল।

যদি রাষ্ট্রপতিকে বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং প্রধানমন্ত্রীকে দুর্বল করা হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি-পন্থী এবং সংসদ-পন্থী দুটি ভিন্ন প্রশাসনিক বলয় গড়ে উঠতে পারে, যা রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে।

৩. দুর্বল সরকার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অচলাবস্থা

যদি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো হয়, তাহলে বিশেষ করে জোট সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়তে পারে। নীতিনির্ধারণে দেরি হবে, এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক টানাপোড়েন বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে শক্তিশালী ও কার্যকর নেতৃত্বের প্রয়োজন, সেখানে দুর্বল সরকার গঠনের ঝুঁকি নেয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

৪. আমলাতন্ত্রের প্রভাব বৃদ্ধি ও দুর্নীতি

রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। তখন জনপ্রতিনিধিদের বদলে আমলারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, যা রাজনৈতিক জবাবদিহিতা নষ্ট করবে।

৫. জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতিতে জটিলতা

বাংলাদেশ একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ, যেখানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হয়। যদি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস পায়, তাহলে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

সাংবিধানিক ও আইনগত জটিলতা

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করতে হলে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে, যা সাংবিধানিক ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়।

১. সংবিধানের সংশোধন বাধ্যতামূলক

বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৫, ৫৬, এবং ৭০ অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রীকে কার্যনির্বাহী প্রধান হিসেবে নির্ধারণ করেছে। এই ক্ষমতা পরিবর্তন করতে হলে সাংবিধানিক সংশোধন আনতে হবে, যা কেবল সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়, রাজনৈতিক ঐকমত্যও প্রয়োজন।

২. সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিতে আঘাত

সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করলে তা রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার দিকে দেশকে ঠেলে দিতে পারে। এতে সাংবিধানিক দ্বন্দ্ব বাড়বে এবং গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

৩. দলীয় শৃঙ্খলার সংকট (অনুচ্ছেদ ৭০)

বাংলাদেশের অনুচ্ছেদ ৭০ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যরা দলীয় নির্দেশনার বাইরে গিয়ে ভোট দিতে পারেন না। যদি প্রধানমন্ত্রী দুর্বল হন এবং সংসদীয় কমিটিগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো হয়, তাহলে এটি সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি করবে।

৪. আইন প্রণয়ন ও নীতি বাস্তবায়নে জটিলতা

যদি প্রধানমন্ত্রী দুর্বল হন, তাহলে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। এটি নীতিনির্ধারণে অচলাবস্থা সৃষ্টি করবে, যা প্রশাসনের গতিশীলতা ব্যাহত করবে।

সম্ভাব্য সমাধান ও ভারসাম্য রক্ষা

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের চেয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করা জরুরি। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে তা পরিকল্পিতভাবে করতে হবে। কিছু সমাধান হতে পারে—

নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, ও বিচার বিভাগকে আরও স্বাধীন করা— এতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।

স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা— যাতে কেন্দ্রে সব সিদ্ধান্ত নিতে না হয় এবং স্থানীয় প্রশাসন নিজেই সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে।

সংসদের ভূমিকা জোরদার করা— সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো এবং সংসদ সদস্যদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

সরকারি প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা— যেন আমলারা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দুর্বল করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন।

পরিশেষে এতটুকুই বলবো,
বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করা হলে প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তবে, এর বিকল্প হিসেবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।

রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ। এজন্য শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা পরিবর্তন নয়, বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করা।

You may also like

Leave a Comment

NatunMatra Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: অভিলাস দাস তমাল

বার্তা সম্পাদক: এহেসান হাবিব তারা

উপদেষ্টা: মাসুদ রানা রাব্বানী

নিউমার্কেট পূবালী  ব্যাংকের গলি, সুলতানাবাদ, ঘোড়ামারা, রাজশাহী – ৬১০০

মোবাইল: ০১৭৭২-৩৫৯২২২, ০১৭১১-৯৫৪৬৪৭ 

মেইল: news@natunmatra24.com

Edtior's Picks

Latest Articles

Natun Matra All Right Reserved. Designed and Developed by Ecare Solutions

শিরোনাম: