Home » গল্পটা আমাদের দুজনের ছিল

গল্পটা আমাদের দুজনের ছিল

by নিউজ ডেস্ক
views

গল্পটা আমাদের দুজনের ছিল। আমাদের জুড়ে শুধুই আমরা। ‘আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ’ কবিতার এই লাইনগুলোর মতোই সুখ ছিল আমাদের। ভেতরে ভেতরে যে গোপন দুঃখ ছিল না তা নয়। তারপরও দুঃখকে জয় করার মন্ত্র শিখে নিয়েছিলাম আমরা, আমাদের মতো করেই। তবে গল্পে আমাদের তিনজনেরই থাকার কথা ছিল। কিংবা হতে পারত চারজনের। আমাদের মধ্যে যে কোনো সময় তৃতীয় একজন ঢুকে পড়বে এমন একটা সম্ভাবনা ছিল সবসময়ই। যদিও মাঝে মাঝে এই সম্ভাবনাকে আমি আশঙ্কা ভেবে স্তিমিত হয়ে যেতাম। শুধু আমি না, আমরা দু’জনেই হয়তো আশঙ্কায় থাকতাম। আমরা দুজন একে অন্যের গায়ে গায়ে লেগে থাকতাম। বৃষ্টি হলে ছাদে গিয়ে ভিজতাম। আমাদের দুজনের বেদনার জায়গাটা একই হওয়াতে আমাদের মন খারাপের সময়গুলোতে আমরা একে অন্যের বুকের সাথে শক্ত করে লেপ্টে থাকতাম। ইন্টার ট্রান্সফারের মতো আমাদের গোপন কষ্ট একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে চলে যেত।

ছুটির দিনগুলো ছিল আমাদের জীবনের সেরা দিন। কারণ এ দিনগুলোতে সারাক্ষণ আমরা একসঙ্গে থাকতাম। একসঙ্গে খেলতাম। ঘর গোছাতাম। গাছের যত্ন নিতাম। অনেক ধরনের গাছ ছিল আমাদের। সন্ধ্যামালতী, নয়নতারা, অলকানন্দা, বেলী, হাসনাহেনা, রুয়েলিয়া, রেইনলিলি, অ্যালোভেরা, কাটামুকুট, বোগেনভিলিয়াসহ আরও বিভিন্ন রকম পাতাবাহার। গাছগুলোর সঙ্গে আমাদের খুব মায়ার সম্পর্ক ছিল। গাছগুলোতে যেদিন সুগন্ধী ফুল ফুটতো, সেদিন সে কিছুক্ষণ গভীর আবেগে ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখতো। বিশেষ করে যেদিন থোকায় থোকায় বেলী ফুটত সেদিন দেখতাম কিছু ফুল তুলে এনে পড়ার টেবিলের উপর রাখা ছোট্ট ফটো ফ্রেমটার সামনে ছড়িয়ে রাখতো। বেলী ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণে আমাদের ঘরটা বড্ড মায়াবী হয়ে উঠতো।

বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলেও একসঙ্গেই যেতাম আমরা। আমাদের একজনকে দেখলে পরিচিত মানুষজনেরা ডানে-বামে, কিংবা আগেপিছে তাকিয়ে আরেকজনকে খুঁজে নিতো। ছুটির দিনের সকাল বেলার সময়টা আমাদের খুব প্রিয় ছিল। কারণ ঘুম ভাঙার পরও সেই দিনগুলোতে আমরা অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে আলসেমি করতাম। শুয়ে শুয়েই কত এলোমেলো কথা বলতাম। আমি অবশ্য শ্রোতাই থাকতাম বেশির ভাগ সময়ই।

তারপর আমরা দু’জনে মিলেই নাস্তার আয়োজন করতাম। ছুটা কাজের মানুষটা আসলে আমাদের রান্নার কষ্ট তেমন করতে হতো না। সেই রান্নাবান্না করে যেতো। আর যেদিন ছুটা বুয়াটা আসতো না, সেদিন আমাদের বেশ বিপত্তিই হয়ে যেতো। তবে দিনটা ছুটির দিন থাকলে কিন্তু আমরা থাকতাম স্বর্গলোকে। সেদিন আমাদের ধরাবাঁধা কোনো শৃঙ্খল থাকতো না। কোনো কোনো ছুটির দিনে বিকাল বেলায় আমরা বটতলী রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে থাকতাম। আমরা ভাবতাম কোনো একটা ট্রেন হয়তো শুধু আমাদের জন্যই এই প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াবে। বিকালবেলায় যারা হাঁটতে বের হয় তাদের অনেকে রেললাইনের প্ল্যাটফর্মের পাশের খোলা জায়গাটায় হাঁটে। সে হন্টনরত মানুষগুলোর মধ্যে কেউ কেউ খুব উৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাতো। হুঁইসেল বাজিয়ে এক একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্ম স্পর্শ করতো, আমরা কেমন অবাক করা চোখে ট্রেন থেকে বের হওয়া মুখগুলো দেখতাম। ভ্রমণ ক্লান্তি পেরিয়ে এক একটা মুখে এত প্রশান্তি থাকতো তা দেখে আনমনে আমরা গোপন দীর্ঘশ্বাস ছাড়তাম। মনে হতো এই ট্রেন আমাদের জন্য নয়। আমাদের যাত্রী এই ট্রেনে নেই। আমাদের যাত্রী যে আসলে কোন ট্রেনে তা আমাদের বোঝার সাধ্যি ছিল না। আমাদের আসলে কোনো যাত্রীই ছিল না। তবুও এমন প্রতীক্ষা আমরা করেই যেতাম।

banner

ছুটির দিনে আলস্যে ভরা সময়টাতে মাঝেমধ্যে আমাদের গল্পে তৃতীয়জনের কথা আসতো। ভবিষ্যৎ সেই তৃতীয়জনের কথা ভেবে কখনো আমরা মজা করতাম, কখনো অভিনয় করে তার আকার, আকৃতি, হাবভাব দেখিয়ে খিকখিক করে হাসতাম, কখনো ভয়ও পেতাম। আবার মাঝেমাঝে ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিও রোমন্থন হতো। সেই রোমন্থনে অবশ্য আমি খুব ভালো সঙ্গী হতে পারতাম না।

তারপর একদিন ঘটনাটা ঘটেই গেলো। ঘটবে ঘটবে সম্ভাবনা যখন জেগেছে তখন থেকেই আমার মনে শঙ্কা হচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল এবার তবে সত্যিই বাঁধন ছিঁড়ল। সত্যি বলতে আমি অনেক কেঁদেছিলামও। কিন্তু তার গোপন কান্নাও আমি দেখেছি। এমন একটা ঘটনা ঘটবে ঘটবে করেও অনেকগুলো দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর আমরা ধরেই নিয়েছি এমন আর কিছু হয়তো আপাতত ঘটবে না। খুব ভালো কি ছিলাম আমরা? তবে খুব যে খারাপ ছিলাম তা বলা যাবে না কোনোভাবেই। কারণ আগেই বলেছি আমরা বেঁচে থাকার মন্ত্র শিখে গিয়েছিলাম। আমরা দুষ্টুমির ছলেই বলতাম ভবিষ্যৎ তৃতীয়জনের কথা। আমার কিংবা আমাদের বিশেষ বিশেষ দিনে আমরা খুব বিষণ্ণ থাকতাম ফেলে আসা তৃতীয়জনের জন্য। যেই গল্পটা আমাদের তিনজনেরই হওয়ার কথা ছিল। কিংবা হতে পারতো চারজনের।

তারপর যেদিন থেকে গল্পটা নতুন করে আমাদের তিনজনের হতে চলল, সেদিন থেকে মূলত গল্পটা আমার একার হয়ে গেলো। বাবা বিয়ে করেছেন। যাকে বিয়ে করেছেন তাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। বাবাই চেয়েছেন তাকে আমার জন্য। মা হারা ছেলে আমি। আমার যখন চার বছর বয়স তখন আমার আরেকটি জীবন্ত খেলার সঙ্গী আনতে গিয়ে মা নিজেই হারিয়ে গেলেন। আমাদের গল্পটা আর চারজনের হলো না। তিনজনেরও থাকলো না। প্রথম কিছুদিনের স্মৃতি আমার সেরকম স্পষ্ট মনে নেই। শুধু মনে আছে বাবা যতক্ষণ বাসায় থাকতো তার বেশির ভাগ সময়ই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতো। কাঁদতো না। কিন্তু চোখ ভেজা থাকতো। সারাক্ষণ মনে হতো এই বুঝি মুখ ধুয়ে এসেছে।

ধীরে ধীরে সব ক্ষতরই প্রকাশ্য রূপটা হালকা হয়ে আসে। আমাদের বেলায়ও তাই ঘটেছে। শোক, সান্ত্বনা দেয়ার মানুষগুলো নিজেদের দৈনন্দিন ছক বাঁধা জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জীবন, জীবিকার তাগিদে বাবাকেও শোক আড়াল করে উঠে দাঁড়াতে হয়েছে। আমার তখনও এসব বোঝার কথা ছিল না। আমি শুধু বুঝেছি এই পৃথিবীতে এত এত মানুষ, শুধু আমার মা নামক ঘ্রাণটি নেই। মার শরীরের ঘ্রাণ ছিল কাগুজি লেবুর মতো। তারপর ধীরে ধীরে একটা সময় বাবার শরীরে আমি কাগুজি লেবুর ঘ্রাণটা পেতে থাকি। আমার মনে আছে মা আমাকে গান শোনাতো। ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস জ্বেলে করবো নিবেদন, আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন’- কবিগুরুর এই গান প্রতিদিন আমাকে নতুন করে মার চেহারা মনে করিয়ে দিতো। কিন্তু মা নেই তাতে খুব বেশি হাহাকার লাগতো না। কারণ বাবা নিজেকে একই সাথে আমার বাবা এবং মা হিসেবে রূপান্তর করে নিচ্ছিল প্রতিদিন।

কিন্তু সমস্যা করতো আমার দাদি। দাদি গ্রামেই থাকে আমার জেঠুর সাথে। শহরের বদ্ধ ঘরে তার নাকি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তাই তিনি শহরে আসেন কালেভদ্রে, নেহায়েত কোনো প্রয়োজনে। আমি আর বাবাই দু’তিন মাস পরপর দাদিকে দেখতে যাই গ্রামে। যখনই দেখতে যাই দাদি আমাকে ডেকে ঘ্যানঘ্যান করে, দীপ্ত, দাদু ভাই, একটা মা দরকার আছে তো। কতদিন বাবাটা একলা থাকবে? তুমি, তোমার বাবাকে বলো, তোমার মা চাই।

দাদি যখন এমন কথা বলতো, আমার খুব মন খারাপ হতো। কখনও খুব কান্নাও আসতো। আমার মনে হতো, কই আমার আর বাবার তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। দাদিকে খুব পঁচা লাগতো। দাদিকে দেখতে যেতেও ইচ্ছে করতো না।

তারপর যখন আরেকটু সময় গেলো আমার দুই ফুফু আমাকে বোঝাতে থাকলো, একটা সময় যখন আমি বড় হয়ে যাবো, পড়ালেখায় ব্যস্ততা বেড়ে যাবে, বাবা নাকি তখন খুব একা হয়ে যাবে। নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। সত্যি বলতে ফুফুদের মুখে এমন কথা শুনে তখন বাবার জন্য আমার অনেক খারাপ লাগতো। সবাই বলতো, বাবার বয়স এখনও অনেক কম। তাই বাবার নিজের কথাও ভাবা উচিত। আবার আমার কথা ভেবেও নতুন একজন মা আনা উচিত। বাবার নতুন করে জীবন শুরু করা উচিত। আর বলতো, তুই যখন বড় হবি, যখন তোর নিজের জীবনে অন্য কেউ আসবে, তোর নিজের সংসার হবে তখন তোর বাবাকে দেখবে কে? তখন তোর বাবা একা থাকবে কিভাবে? এসব কথা শুনে বাবার কেমন লাগতো আমি জানি না, তবে আমার খুবই কষ্ট হতো। যেদিন এসব কথা হতো সেদিনগুলোতে রাতে ঘুমানোর সময় বাবাকে আমি অন্যদিনগুলোর চেয়ে অনেক বেশি শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম।

প্রজ্ঞা আন্টি বাবার সাথে একই অফিসে কাজ করে। কথাও বলে সুন্দর করে। কথার মধ্যে বেশ মায়াও আছে। আমারও ভালো লাগতো প্রজ্ঞা আন্টিকে। আমরা একসাথে বাবার অফিসের পিকনিকে যখন গিয়েছি তখন অনেকটা সময় প্রজ্ঞা আন্টি আমাকে আগলে রেখেছেন। পিকনিকের আয়োজক কমিটিতে নাম থাকায় বাবাকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। সেই ফাঁকে প্রজ্ঞা আন্টির সাথে আমার বেশ ভাব হয়ে যায়। উদালিয়া চা বাগানের সেই মেঠো পথ ধরে যখন আমি আর প্রজ্ঞা আন্টি হাঁটছিলাম তখন প্রজ্ঞা আন্টি আমাকে দেখিয়েছিল সবুজ ঘাসের উপর কেমন করে মানুষ পদচিহ্ন আঁকতে আঁকতে একটা সময় মসৃণ পথ বানিয়ে ফেলে। চা বাগানের ভেতর ঢুকে আমরা নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলেছিলাম। অন্য মায়েরা যেভাবে তাদের সন্তানদের নিয়ে আদিখ্যেতা করে প্রজ্ঞা আন্টি আমার সাথে তাই করছিলেন। সেই মুহূর্তগুলোতে আমার খুব মায়ের কথা মনে পড়ছিল। আমার মাও কি এমন করতো!

বাবা যখন প্রজ্ঞা আন্টিকে বিয়ে করার কথা বললো তখন থেকে আমার বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে যেতে লাগলো। এই প্রথম আমার খুব একা একা লাগলো নিজেকে। আমার মনে হলো আমাদের দুইজনের গত নয় বছরের গল্পটার ইতি ঘটছে। আমার আরও মনে হলো যে ঘরটা এক সময়ে আমার বাবা মায়ের ছিল, তারপর মা হারিয়ে যাওয়ার পর যে ঘরটা আমাদের দুজনের হলো আজ থেকে সে ঘরটাতেই আমি বহিরাগত। কেন যে এত কান্না পেয়ে গেলো! কান্নার দমকে বাবা ভয় পেয়ে গেলেন। আমাকে বুকের সাথে লাগিয়ে বললো, আমার বাবাটা কাঁদছে! সব বাদ। সব। আমাদের কাউকে দরকার নেই। এটা শুধুই আমাদের সংসার। আমাদের বাপ-বেটার সংসার। বাবার গলায় এত দরদ ছিল যে আমার ভেতর থেকে উঠে আসা কান্না কোনো ভাবেই সামাল দেয়া যাচ্ছিল না। আমি দেখেছি বাবার চোখেও পানি।

বাবার বিয়েতে বরযাত্রীর মধ্যে আমিও ছিলাম। বাবার এটা দ্বিতীয় বিয়ে হলেও প্রজ্ঞা আন্টির প্রথম। তাই তাদের পক্ষ থেকে আয়োজনের ঘাটতি ছিল না। বাবাকেও কেন জানি কিছু সময়ের জন্য হলেও দেখলাম বেশ আনন্দের ভেতর আছে। প্রজ্ঞা আন্টির সাথে প্রথম থেকেই যখন বাবাকে গল্প করতে দেখেছি আমার মনে হয়েছিল বাবার সময়টা ভালো কাটছে। বাবার চোখে মুখে সতেজ একটা ভাব থাকতো। বাবা আমার জন্য তার জীবনের নয়টা বছর একাকীত্বের ভেতর কাটিয়েছে, এ কথা বাবা আমাকে না বললেও আমাদের আত্মীয় স্বজনরা আমাকে প্রায় মনে করিয়ে দিতো।

বাবার সময়গুলো ভাগ হয়ে যাচ্ছিল। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তা হচ্ছিল। ছুটির দিনগুলোতে আমার খুব হাঁসফাঁস লাগতো। আমি ছবি আঁকায় মন দিতাম। বই পড়তাম। আর বারান্দার গ্রিল ধরে দূরের আকাশ দেখতাম। জানালার কার্ণিশে চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছিল। আমি সেই চড়ুইদের হুটোপুটি দেখতাম। আমার ছোট্ট একটা একোরিয়াম ছিল। সেখানে দুইটা গোল্ড ফিশ ছিল। বাবা বলতো গোল্ড ফিশদের সংসার আর আমাদের সংসারের সদস্য এক। তারপর প্রজ্ঞা আন্টিকে বিয়ে করার পর বাবা আরও দুইটা গোল্ড ফিশ এনেছিল। কয়েকদিন পর একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি একটা গোল্ড ফিশ মরে ভেসে আসে। কি যে কান্না এসেছিল আমার। মনে হচ্ছিল আমার নিজের কেউ হারিয়ে গেছে। বাবা অফিস থেকে ফিরে আমার চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা হয়েছে। যতই বলছি, গোল্ড ফিশটা কেন মরে গেল বাবা? সবাইকে কেন মরে যেতে হয়? আরও কি কি এলোমেলো বকেছিলাম এখন আর মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে অনেকদিন পর সেদিন রাতে বাবা আমার সাথে ঘুমিয়েছিল। সেদিন বাবার গায়ে কাগুজি লেবুর ঘ্রাণটা আবার খুঁজে পেয়েছিলাম।

আমার নাকের কাছে হঠাৎ করে কাগুজি লেবুর ঘ্রাণ লাগতেই চেয়ারে বসে নিচু করে রাখা মাথাটা সামনের দিকে তুলে ধরতেই দেখি ডাক্তার তূর্ণা আমার সামনে। এই ভদ্রমহিলা কি পারফিউম মাখে কে জানে? একদম মায়ের শরীরের ঘ্রাণটা মনে করিয়ে দেয় বারবার। ডাক্তার তূর্ণার চেহারাটা মলিন। আমি উঠে দাঁড়াতেই আস্তে করে বললো- মানুষের ক্ষমতা খুব সীমিত। মুহূর্তেই আমার মনে হলো আমার চোখের সামনে ঢেউ খেলছে। সব কেমন ঝাপসা লাগছে। ডাক্তার তূর্ণাকেও খুব ঝাপসা লাগছে।

আমি বলেছিলাম আমাদের জীবনে তৃতীয় কেউ না হলেও চলবে। কুমকুম বুঝতে চায়নি। হয়তো সব মেয়ের বেলায় এ কথাই সত্যি। মাতৃত্বের অনুভব সে তো ছেলে হয়ে বোঝার ক্ষমতা প্রকৃতি আমাকে দেয়নি। তাই হয়তো কুমকুমকে আমি বোঝাতে পারিনি। ৫ মাসের দিকেই ডাক্তার বললেন, কুমকুমের হিমোগ্লোবিন অনেক কম। বেশি বেশি খেতে হবে। ৭ মাসের সময় বললো, ওর বেড রেস্ট দরকার। প্লাসেন্টা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আর তারপর হঠাৎ করেই আজ দুপুরের দিকে ফোন। বাসায় ছুটে এসে কুমকুমকে দেখে মনে হচ্ছিল ওর বুকের উপর বোধহয় ভারি একটা পাথর চেপে রেখেছে কেউ। দরদর করে ঘামছিল। ম্যাক্সির নিচের দিকটা লাল স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল। চেহারাটা দলা পাকানো কাগজের মুচড়ে যাচ্ছিল বারবার। ডাক্তার তূর্ণাকে ফোন করে হসপিটালে আনার সময়টুকুন আমি ভুলে যেতে চাই। মানুষের চাপা গর্জন কি ভয়ানক হয়, মানুষের শরীরের মধ্যে প্রাণটা কিভাবে নেচে বেড়ায় সব যেন স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছিল আমার চোখের সামনে।

ওটির বাইরে অপেক্ষা করতে করতে মার কথা খুব মনে পড়ে। মারও কি এমন কষ্টই হয়েছিল। সব মায়েরই এমন কষ্ট হয়! বাবা কিছুক্ষণ পরপর ফোন করছে। প্রজ্ঞা আন্টি ফোন করছে। ওদের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা প্রকট। কুমকুমকে ওটিতে নেয়ার পর হঠাৎ করে আমি খেয়াল করলাম আমার অস্থিরতা অনেক কমে গেছে। অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার মতো কাছাকাছি একটা অনুভূতি। জীবনের অমূল্য সম্পদ যে একবার হারিয়ে ফেলে সে আর নতুন করে হারানোর ভয় পায় না। তেত্রিশ বছরের জীবনের দ্বিতীয় বছরই যে হারানোর স্থূল বেদনা দিনে দিনে প্রকটভাবে সূক্ষ্ম হয়ে জীবনের সাথে অক্টোপাসের মতো আলিঙ্গন করে আছে সে জীবনে নতুন করে আর হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে থাকার মতো অবস্থা হয় না। ধরে নিতে হয় এটাই নিয়তি। প্রজ্ঞা আন্টির ঘরে আমার আদরের একটা পাখি আছে। আমার ছোট বোন তিতলি। তিতলি কিছুক্ষণ আগে ফোন করে বললো, ভাইয়া গতকাল রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি একটা ছোট্ট পুতুল নূপুর পায়ে টুনটুন শব্দে সারাঘর জুড়ে ছুটোছুটি করছে। আমরা সবাই ওর পিছুপিছু ছুটছি। কিন্তু ওকে ধরতেই পারছি না। ও শুধু খিলখিল করে হাসছে আর ছুটছে। স্বপ্নটা দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু মাকে স্বপ্নের কথা বলার পর মা বললো, আমি নাকি ভালো স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে মানুষ যা দেখে তা নাকি উল্টো হয়। এই তথ্যটা কি সত্যি ভাইয়া? আমি তিতলির কথার জবাব না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে ফোন রেখে দেই।

ওরা সবাই অপেক্ষা করে আছে কুমকুমের জন্য। আমাদের দু’জনের সংসারের তৃতীয়জনের জন্যও। আমিও অপেক্ষা করে আছি। কিন্তু ডাক্তার তূর্ণার কথায় কেন জানি সবকিছু দোদুল্যমান হয়ে যাচ্ছে বারবার। আমার খুব ভয় হচ্ছে গল্পটা আমাদের দু’জনের থাকবে তো! নাকি আবার গল্পটা আমার একার হয়ে যায়! কুমকুম কেন যে বুঝতে চাইলো না একার জীবনটা খুব বিষাদের হয়। খুব বেশি বিষণ্ণতায় ভরা!

You may also like

Leave a Comment

NatunMatra Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: অভিলাস দাস তমাল

বার্তা সম্পাদক: এহেসান হাবিব তারা

উপদেষ্টা: মাসুদ রানা রাব্বানী

নিউমার্কেট পূবালী  ব্যাংকের গলি, সুলতানাবাদ, ঘোড়ামারা, রাজশাহী – ৬১০০

মোবাইল: ০১৭৭২-৩৫৯২২২, ০১৭১১-৯৫৪৬৪৭ 

মেইল: news@natunmatra24.com

Edtior's Picks

Latest Articles

Natun Matra All Right Reserved. Designed and Developed by Ecare Solutions

শিরোনাম: