
সামছুল আলম দুদু-এমপি:
আওয়ামী লীগ একটি বৃহত্ রাজনৈতিক দল। বাঙালির ঐতিহ্যের অঙ্গীকারে পরিপুষ্ট এই দলটির ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। কে জানতো এই আওয়ামী লীগই একদিন বাঙালি জাতির মুক্তির ঠিকানা খুঁজে দেবে! অবশ্য এ দলটির উত্স ধারায় মুসলিম বাঙালির সংস্কৃতি উত্কর্ষিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তাকে ধারণ করতে গিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালির চেতনা প্রকটিত হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, তত্কালীন পশ্চাত্পদ মুসলিম জনগোষ্ঠীর একমাত্র প্লাটফর্ম হিসেবে মুসলিম লীগ গঠিত হয়। সেই মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ নবদর্শন জাগ্রতকরণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেন প্যালেসে ঐতিহাসিক সম্মেলনের মাধ্যমে। ব্রিটিশ শাসনের ইতি ঘটে ১৯৪৭ সালে। ইংরেজদের কূটচালে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণে বিভক্ত হয় বৃহত্ ভারতবর্ষ। যেটা ইতিহাসে দ্বিজাতিতত্ত্ব নামে খ্যাত। ভারত-পাকিস্তান নামের দুইটি স্বাধীন সত্তার রাষ্ট্র গঠিত হয়। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি অবাঙালি মুসলমান শাসকের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে শুরু থেকেই। এতে মুসলিম বাঙালির মোহভঙ্গ হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রদেশিক মুসলিম লীগের একাংশ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। ১৯৪৯ সালে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শামসুল হক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে শানিত করার লক্ষ্যে সংগঠন থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে গঠন করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের জন্মকালের সঙ্গে ১৫০ নম্বর মোগলটুলীস্থ পূর্ববঙ্গ কর্মীশিবিরের উদ্যোগের সম্পর্ক অনস্বীকার্য। এই কর্মশিবিরকে ঘিরেই আওয়ামী লীগের কর্মতত্পরতা চলতে থাকে। ঐতিহাসিক কারণেই ১৫০ মোগলটুলীস্থ বাড়িটি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। আর এই বাড়িটির কর্ণধার ছিলেন শওকত আলী (প্রয়াত)। শওকত আলীর অনুরোধে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কোলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন একটি মামলা পরিচালনার জন্য। জনাব সোহরাওয়ার্দী সাহেব শওকত আলীকে পরামর্শ দেন মুসলিম লীগ ছেড়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার। শওকত আলী এতে অনুপ্রাণিত হন এবং কর্মীশিবিরের প্রধান নেতা শামসুল হক সবাইকে সংগঠিত করেন। তরুণ তুর্কি শেখ মুজিবুর রহমান কর্মশিবিরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মতত্পরতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মূলত মুসলিম লীগের অন্যায় কাজরে বিরুদ্ধেই কর্মীশিবির গঠিত হয়েছিল।
১৯৫৭ সালে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে আওয়ামী লীগে ভাঙন দেখা দেয়। এ বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রয়ারি টাঙ্গাইল কাগমারি সম্মেলনে দলের বিভক্তি ঘটে। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। সীমাহীন জেলজুলুমের শিকার হয়েও শেখ মুজিব কখনো লাইনচ্যুত বা লক্ষ্যচ্যুত হননি। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণেই শেখ মুজিব সবাইকে ছাড়িয়ে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন দলকে। নিজেও উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত হন। তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির কাণ্ডারি। তাকে ঘিরেই বাঙালি জাতি স্বপ্ন দেখেন। বাঙালি বুঝতে পারে শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই শোষণমুক্তি ঘটবে। ঠিক তা-ই ঘটে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি স্বৈরশাসক নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নিরীহ বাঙালি জাতির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ গভীর রাতে জান্তাবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানের কারাগারে। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামকরণ করে ২৬ শে মার্চ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই থেকে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। মূলত বঙ্গবন্ধুর নামের জাদুতেই দেশ শত্রুমুক্ত হয় মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে। এ যুদ্ধে প্রতিবেশী ভারত প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। সেনাবাহিনী ও গোলাবারুদ দিয়ে ভারত সাহায্য না করলে এত দ্রুত বিজয় অর্জন সম্ভব হতো না। তাই বাঙালি জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আসছে সবসময়। স্বাধীনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং বাংলাদেশকে সফল ও সার্থক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বর্ণোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে আসছে। একটি কুচক্রীমহল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সবসময় চক্রান্ত করে চলেছে। বহুবিধ ঘাত-প্রতিঘাতের শিকার আওয়ামী লীগকে কেউ দমাতে পারেনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল শত্রুরা। আমাদের সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান। আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মহীরূপ ধারণ করেছে।
উল্লেখ্য, খ্রিষ্টজন্মের প্রায় চৌদ্দশ বছর আগে ভারতবর্ষে একজন বড় দার্শনিকের জন্ম হয়েছিল। তার নাম পতঞ্জলি। সমাজ নিয়ে তিনি যে ভাবনা ভেবেছিলেন সেই ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সমাজে, ঠিক তেমনিভাবে শেখ মুজিব জন্ম নিয়েছিলেন একজন দার্শনিক হিসেবে। তিনি মনে করেছিলেন, সংগঠন ছাড়া কোনো আশাই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তাই আওয়ামী লীগের মতো সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। একটি নতুন ভাবনার প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণই হবে এই সংগঠনের লক্ষ্য। লক্ষ্য বাস্তবায়নে বৃহত্ শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠা করেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। দলের সমগ্র নেতাকর্মীরা তার ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে আসছেন। আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে কোনো দেশের সফলতার পেছনে রাজনৈতিক সংগঠনের ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ স্বপ্নযাত্রার পাথেয় হয়ে নতুন ইতিহাসের জন্ম দেবে এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক : জাতীয় সংসদ সদস্য ও স্বরাষ্ট্র মণন্ত্রালয় বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য