Home » বিএনপি’র ৩১ দফা; সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রবর্তন যে কারণে প্রয়োজন

বিএনপি’র ৩১ দফা; সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রবর্তন যে কারণে প্রয়োজন

by নিউজ ডেস্ক
১৪৮ views

মো: আবু সাঈদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়:
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে জাতির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা উপস্থাপন করেন। ৩১ দফায় এমন সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে দেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান অধিকতর স্বচ্ছ ও স্বাধীনভাবে কাজ করবে, সংগত কারণে নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি পাবে।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সম্পর্কে বলা হয়েছে ১০ নম্বর দফায়। ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রবর্তন’ বাক্যাংশটি দ্বারা স্পষ্টত প্রতীয়মান কোনো একসময় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধানে ছিলো যা পরবর্তীতে সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয়।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কি?
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এমন একটি বডি যা গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও পরবর্তী দুজন প্রবীণ বিচারপতি নিয়ে। এ কাউন্সিল মূলত বিচারপতিদের আচরণবিধি ও অপসারণ প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে।

banner

বিএনপি কেন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পুনঃপ্রবর্তন চায়?
এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পেতে ১৯৭২ সালের সংবিধান অর্থাৎ মূল সংবিধান কর্তৃক বিচারপতি অপসারণ প্রক্রিয়া, ১৯৭৫ সালের সংবিধান অর্থাৎ চতুর্থ সংশোধনীর সংশোধনীর মাধ্যমে অপসারণ প্রক্রিয়া এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক বিচারপতি অপসারণ প্রক্রিয়া নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা প্রয়োজন।

প্রথমত, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের পদের মেয়াদ নিয়ে আলোকপাত করেছে। ৯৬ অনুচ্ছেদে ছিলো-

* যদি কোনো বিচারপতির অসদাচরণ ও অসামর্থ্য প্রমাণিত হয়।
* সংসদের দুই- তৃতীয়াংশ সমর্থন আকারে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায়।
* সংসদ কর্তৃক সমর্থিত প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতি আদেশ দেয়।

তাহলেই কেবল একজন বিচারপতি কে অপসারণ করা যেতো। এ প্রক্রিয়া টি মোটামুটি স্বচ্ছ কেননা অসদাচরণ, অসামর্থ্যতা প্রমাণ হওয়ার পর ও দুটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়।

পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের অপসারণ নিয়ে পরিবর্তন আনেন যা বিচারবিভাগের উপর স্পষ্ট চপেটাঘাত। মূল সংবিধানে বিধান ছিলো বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ প্রমাণিত হলে তাকে অপসারণ করা যাবে। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনী তে প্রমাণিত (proved) শব্দ টি বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিচারপতিদের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যতা প্রমাণিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন অসদাচরণ করেছে তাহলেই কেবল অপসারণ করতে পারতেন। মূল সংবিধান অনুযায়ী অধস্তন আদালতের বিচারকদের অপসারণের বিধান সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত থাকলেও সেটা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয় যা বিচারবিভাগের স্বাধীনতা কে জঘন্য রকমভাবে খর্ব করা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতির অপসারণ যখন রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনিচ্ছার নির্ভর করতো তখন বিচারবিভাগের কি নাজেহাল অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়।

বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা প্রদানের নিশ্চয়তা ও সমুন্নত রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ নেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (বীরউত্তম)। উনি Second Proclamation Order,1977 জারি করে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে প্রথমবারের মতো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান সন্নিবেশ করেন। তৎপরবর্তী সময়ে চলতে থাকা বিচারপতি অপসারণের এ প্রক্রিয়াকে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মাধ্যমে বাদ দিয়ে মূল সংবিধানের বিধান অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধানের নিয়ে আসতে চান। পৃথিবীর অনেক দেশে বিচারকদের অপসারণের ভার সংসদের হাতে থাকলেও বাংলাদেশের সংসদকে সে গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা অনুচিত। কারণ সে দেশগুলোতে সাংসদগণ মুক্তচিন্তা ও বিবেকবোধ প্রয়োগ করে সংসদে ভোটদান করতে পারলেও বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে নিজ দলের বিপক্ষে ভোটদান করলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হয়। ২০১৪ সালে নির্বাচিত মোট পার্লামেন্টারিয়ানদের ২৩৪ জন আওয়ামী লীগের হওয়ায় বিচারক অপসারণের দুই- তৃতীয়াংশ সমর্থন পাওয়া আনুষ্ঠানিকতা ছিলো মাত্র।

প্রাসঙ্গিক কারণই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

ইতোমধ্যে উল্লেখিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের দায়িত্ব-

* বিচারকদের পালনীয় আচরণবিধি নির্ধারণ করা।
*বিচারকগণের আচরণ ও সামর্থ্য সংক্রান্তে তদন্ত করা।

কাউন্সিল বা অন্য কোনো উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির যদি এরূপ আশংকা করার কারণ থাকে যে কোনো বিচারক –

শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে তার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অসামর্থ্য হয়ে পড়েছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হতে পারেন সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিল কে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করতে এবং এর তদন্ত ফল জ্ঞাপন করার নির্দেশ দিতে পারেন। কাউন্সিল তদন্তের পর যদি রিপোর্ট করেন উক্ত বিচারক উক্ত পদে দায়িত্ব পালনে অসামর্থ্য হয়ে পড়েছেন বা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হয়েছেন তাহলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারক কে তার পদ হতে অপসারণ করবেন।

মূল সংবিধানে বিচারক অপসারণের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় আইন বিভাগ তথা সংসদের হাতে, পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে এমন সংশোধনী এনেছিলেন যাতে কোনোরকম প্রমাণ ছাড়াই রাষ্ট্রপতি বিচারকদের অপসারণ করতে পারতেন। অপরদিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে থাকে বিচারবিভাগের মূল কর্তাব্যক্তিগণ যাদের তদন্তের উপর বিচারকদের অপসারণ নির্ভর করে। এতে বিচারবিভাগের মর্যাদা অধিকতর সমুন্নত থাকে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান কর্তৃকই প্রথম সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রবর্তন হয় যা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে কেড়ে নেয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই সংবিধানে তা পুনঃপ্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেন। বাংলাদেশের বিচারবিভাগ কোনোকালেই পুরোপুরি স্বাধীন না থাকলেও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বরাবরই বিচারবিভাগের উপর তুলনামূলক কম হস্তক্ষেপ করেছেন যা সুপ্রিম জুডিশিয়ালের পুনঃপ্রবর্তনের অঙ্গীকারের মাধ্যমে আবারো প্রমাণিত।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ফিরিয়ে নিয়ে আসেন যা এ সরকারের সেরা অর্জন। ফলশ্রুতিতে বিচারবিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে এবং বিচারক অপসারণের দীর্ঘদিনের গ্যাপ দূরীভূত হলো।

লেখক:
মো: আবু সাঈদ
আহ্বায়ক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইন ছাত্র ফোরাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

You may also like

Leave a Comment

NatunMatra Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: অভিলাস দাস তমাল

বার্তা সম্পাদক: এহেসান হাবিব তারা

উপদেষ্টা: মাসুদ রানা রাব্বানী

নিউমার্কেট পূবালী  ব্যাংকের গলি, সুলতানাবাদ, ঘোড়ামারা, রাজশাহী – ৬১০০

মোবাইল: ০১৭৭২-৩৫৯২২২, ০১৭১১-৯৫৪৬৪৭ 

মেইল: news@natunmatra24.com

Edtior's Picks

Latest Articles

Natun Matra All Right Reserved. Designed and Developed by Ecare Solutions

শিরোনাম: