১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক ওই পরিকল্পনা দিয়ে নারকীয় গণহত্যা শুরু করে। এত কম সময়ে এত বড় গণহত্যা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। মানুষ বুঝে উঠতে পারেনি সে কী করবে। তারপর পথ সব খুলে যায়। মা, মাটি, মানুষ রক্ষায় তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাঙালি দামাল ছেলেরা।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ যার পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। বিজয়েরও একটি বহির্মাত্রা আছে, কারণ বিজয় তো বোধের ও চৈতন্যের কেন্দ্রে বসত করে। সুতরাং বিজয় বা স্বাধীনতা শুধু উদ্?যাপনের নয়, চেতনারও এবং সেই চেতনা ধারণ করতে হবে বর্ষব্যাপী, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। সুদীর্ঘ দুই যুগের পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নিপীড়ন আর সীমাহীন বঞ্চনার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার অমোঘ বাণী বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রমনা রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তারের আগে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং তিনি দেশবাসীকে যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই বর্বরতার নিন্দা এবং বাংলাদেশের পক্ষে সাহায্য ও সহযোগিতার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারপরে অনেক ঘটনা। কিন্তু পাকিস্তানের ভবিতব্য ছিলো এই যে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সেই উদ্যানেই ৯৩ হাজার পাকি হানাদার বাহিনীর সদস্যকে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে হয়। তারপর ঘটে আরেক ট্র্যাজেডি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে দেশ নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। এরই অংশ হিসেবে ‘আমরা বাঙালি’ নাকি ‘আমরা বাংলাদেশি’ এমন অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়। দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিস্ময়করভাবে ঘটেছে, কিন্তু সেই উন্নয়নকে এখনো সমতাভিত্তিক এবং সামাজিক ন্যায্যতাকে নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে সমাজে সুযোগের অসমতা আছে, আয় ও সম্পদের অসম বণ্টন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তরুণ প্রজন্মেরর আবেগী কিংবা বস্তুনিষ্ঠ যোগ সব সময় নাও থাকতে পারে। কারণগুলো সংগতই; হয়তো কেউ তাদের বিষয়টি ঠিকভাবে বলেনি কিংবা তাদের পাঠ্যক্রমে তা অনুপস্থিত থেকেছে বা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ অবস্থায় বিভ্রান্তিমূলক ধারণারও জš§ হতে পারে সহজেই, এগুলো অচিরেই দূর করা দরকার। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমরা কী চেয়েছিলাম ছিলাম আর কী পেয়েছি, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ দরকার, যাতে আমাদের আগামীর পথচলা আরো সুপ্রসন্ন ও কণ্টকমুক্ত হয়। কোনো সন্দেহ নেই যে, দেশ স্বাধীন না হলে বাঙালি আজ বিশ্বে যেভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, তা কখনোই সম্ভব হতো না। এখন প্রশ্ন হলো স্বাধীনতা লাভ করে আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী কতটা কী করতে পেরেছি সেটা। আমাদের মধ্যে এখনো বিভেদ বা মতপার্থক্য বিদ্যমান। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অর্জনকে কেন্দ্র করে বিদ্যমান বিতর্কের অবসান না হলে জাতি হিসাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব তাতে সন্দেহ নেই। আর এতে আমাদের উন্নতি ও সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। স্বাধীনতা চেতনায় উজ্জীবিত হোক তরুণ-যুবা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের। এ প্রত্যাশা আমাদের।